দেবহাটা ভাষাটি ইন্দো ইউরোপীয় মূলভাষা হতে উদ্ভূত মাগধী প্রাকৃত (ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়) মতান্তরে গৌড়ী প্রাকৃত (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) হতে বাংলাভাষার আধুনিক রূপ। উপমহাদেশীয় ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চল পাঁচটা উপ অঞ্চলে বিভক্ত। বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলাকে উক্ত পঞ্চবিভাজনের মধ্যে বাঙ্গালী উপভাষা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তুপ্রকৃতপক্ষে বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা (অবিভক্ত) জেলার দক্ষিণাঞ্চল বাঙ্গালী ও রাঢ়ী উপ ভাষার মিশ্রণে এর নবতর ভাষারূপের সমাহার।
(দেবহাটা উপভাষা স্বরূপ ও স্বতন্ত্র; কাজী মুহম্মদ অলিউল্লাহ :১২২, ২০০৯)। দেবহাটা উপভাষায় রাঢ়ী ও বঙ্গালী রীতির সাধারণ ও মিশ্র বৈশিষ্ট :
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেবহাটার উপভাষা মূলত বঙ্গালী উপভাষার অন্তর্ভুক্ত হলেও অবস্থানগত কারণে অবিমিশ্র বঙ্গালী বৈশিষ্টসমূহ দেবহাটার কথা ভাষায় পুরোপুরি রক্ষিত নেই। তাছাড়া নানাবিধ কারণে উপভাষার বৃহত্তর পরিমণ্ডলের ভেতর সর্বত্র একই রীতি নিখুঁতভাবে বজায় থাকেনা। আঞ্চলিক বৈশিষ্টের দিক দিয়ে যশোর জেলার ওপর রাঢ়ী প্রভাব অপেক্ষাকৃত বেশি, খুলনা জেলার ওপর সেক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম এবং ফরিদপুরের ওপর আরো কম এবং বৃহত্তর খুলনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও অবস্থানগত কারণে দেবহাটা উপজেলার ওপর রাঢ়ী উপভাষার প্রভাব যশোরের থেকেও অপেক্ষাকৃত বেশি, বিশেষত দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে উপভাষায় বঙ্গালী ও রাঢ়ী বৈশিষ্ট কতোটা ও কী পরিমাণ বিদ্যমান তার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট উল্লেখিত হ’লো-
১. বঙ্গালী উপভাষার প্রধান বৈশিষ্ট হ’লো ক্রিয়াপদে অপিনিহিত উচ্চারণ বৈশিষ্ট। দেবহাটার উপভাষায় অপিনিহিতির ই বা উ আগম (বিপর্যাস) আছে ঠিকই, কিন্তুঅক্ষত অবস্থায় নেই। এখানে ই বা উ ধ্বনির আংশিক পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই পরিবর্তন রাঢ়ী প্রভাবান্বিত- যেমন- রাঢ়ীর মানচলিত রীতি- চলছে, চলেছে, চলেছিলো। বঙ্গালী রীতি- চোইলতে আছে/চোইলতাছে, চোইলাছে, চোইলতেছিলো। দেবহাটা উপভাষা : চোইলতেচে, চোইলেচে/ চোই লেচ্ চোই লোলো। লক্ষনীয় যে, রাঢ়ীর আগম ই ধ্বনি এখানে অর্ধলুপ্ত।
২. বঙ্গালী উপভাষায় উ আগম অপিনিহিতি রূপে পুরোপুরি ব্যবহৃত। যেমন- যাউকগিয়া, মাউরা, কাউল্যা ইত্যাদি।
রাঢ়ী বা মান চলিতে- যাগ্গে মেড়ো, কে’লো ইত্যাদি।
দেবহাটার উপভাষায় শ্বদ মধ্যসি'ত আগম উ দ্ভনির বিলোপ ঘটেছে, তবে সেখানে অর্ধ ই (আগম) ক্ষতিপূরণ রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন- জাই গ্গে / মেই ড়ো, কেই লো ইত্যাদি।
৩. বঙ্গালী উপখাশায় শব্দের আদিতে এ ধ্বনির এ্যা / অ্যা প্রবণতা একটা গুরুত্বপূর্ণ উচ্চারণ রীতি। দেবহাটা উপভাষায় সেটা সর্বত্র ব্যবহৃত হয় না। অনভিজাত, গ্রাম্য অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিতদের মধ্যে এবং বিশেষ ক’রে সুন্দরবন সন্নিহিত এলাকায় এই রীতি বজায় থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ জাতীয় এ্যা ধ্বনি ব্যবহৃত হয় না। বরং শিক্ষিত, অনভিজাতদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা ঘটে। যেমন- রাড়ী/মান চলিত- তেল, বেল, বেতন, বেদনা এবং ইত্যাদি।
রঙ্গালী রীতিতে- ত্যাল, ব্যাল, ব্যাতোন, ব্যাদোনা, এ্যাবোং ইত্যাদি।
দেবহাটার উপভাষায় দু’টোই রক্ষিত। তবে মানচলিতের রীতিটা সাধারণত শিক্ষিত, অভিজাত শ্রেণি ও শহরাঞ্চলে প্রযুক্ত হ’য়ে থাকে। পক্ষান্তরে অশিক্ষিত ও গ্রাম্য উচ্চারণে ঠিক তার উল্টোটা ব্যবহৃত হয়। যেম তেল>ত্যাল হয়। ব্যালা>বে-লা ইত্যাদি হয়। অর্থাৎবঙ্গালী প্রভাব পুরোপুরি মুক্ত নয়।
৪. বঙ্গালী অঞ্জল ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখলি প্রভৃতি এলাকায় আদ্য ও দ্বনি উ ধ্বণিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তুএই রীতি দেবহাটার উপভাষা সর্বত্র প্রচলিত নেই।
৫. অ/আদ্য আ-অন-ক ধ্বনিরূপে ফ. ভ মহাপ্রাণ বর্ণের উচ্চারণে বঙ্গালীতে অল্পপ্রাণিভবন ঘটে। যথা- ভয়>বয়, ঘাট>গাট, কফ>কপ ইত্যাদি। কিন্তু দেবহাটার উপভায় রাঢ়ী বা মান চলিত রীতিতেই ব্যবহৃত হয়।
৬. বঙ্গালী উপভাষায় তাড়ন জাতীয় মূর্ধন্য স্বল্পপ্রাণ বা মহাপ্রাণ ধ্বণি ড়. ঢ় এর কোনে উচ্চারণ নেই। সে ক্ষেত্রে শুধু তাড়ন জাতীয় দন্তধ্বনি পার্শ্বিকধ্বনি র’ উচ্চারিত হয়। দেবহাটার উপভাষাতে এ দুটো রাঢ়ী’র মতোই যথাযথভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে।
৭. বঙ্গালী উপভাষার প্রধান বৈশিষ্ট অপিনিহিতি, আর রাঢ়ী প্রধান বৈশিষ্ট অভিশ্রুতি ও স্বরসংগতি। যেমন-
ক. অভিশ্রুতি- ক’রে, দে’খে, রক্ষে, ভাগ্য ইত্যাদি। অথচ বঙ্গালীতে(অপিনিহিতি) ঃ কোইর্যা, দেইখ্যা, রোইক্ষ্যা, ভাইগো ইত্যাদি।
খ. স্বরসংগতি- সাধুরীতি- দেখিয়াছিল। বঙ্গালীরীতি- দেইখ্যাছিল। রাঢ়ী বা মানচলিত রীতি- দেখেছিল (দেখে= স্বরসংগতি)। সাতক্ষীরার উপভাষা- দে/দিইকোলো। অর্থাৎ- মাচভা বা রাঢ়ী- দেখেছিল (দ+এ+খ+এ+ছ+ই+ল+ও)
সাউভা-দে/দিইকোলা(দ+এই+ক(অল্পপ্রাণিভবন)+ও+(ছ+ই(লাপ)ল+ও)।
সাধুরীতি- মরিয়াছি। রাঢ়ী বা মানচলিত রীতি- মেরেছি (মেরে-স্বরসংগতি)। বঙ্গালী রীতি-মাইরাছি
দেবহাটার উপভাষা- মারিচি (রিচি = স্বরসংগতি)।
৮. আদ্যক্ষর বা আদ্যধ্বনিতে শ্বাসাঘাত পড়া এবং পড়ার কারণে পরবর্তী শব্দ মধ্যে বা অনে- অল্পপ্রাণিভবন ঘটা রাঢ়ী রীতির একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট যেটা বঙ্গালীতে বিরণ ক্ষেত্র ছাড়া দেখা যায় না। এই বৈশিষ্টটা দেবহাটার উপভাষায় ব্যাপকভাবে লক্ষিত। যেমন- মধু>মোদু, কাঁঠাল>কাঁটাল, সুখ>শুক ইত্যাদি।
বঙ্গালীতে মধ্য ও অন- ধ্বনিতে সাধারণত মহাপ্রাণধ্বনি ব্যবহৃত হ’য়ে থাকে।
৯. রাঢ়ী উপভাষায় কখনো কখনো সন্ধিজনিত কারণে, কখনো কারণ ছাড়াই অঘোষ ধ্বনি ঘোষবৎউচ্চারিত হয়। যেমন-সন্ধিঘটিত- বটগাছ>বড্গাজ, পাঁচ ভরি> পাঁজ ভোরি ইত্যাদি।
এখানে পরবর্তী ঘোষধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী অঘোষে সমিভবন ঘটেছে। অর্থাৎ= ট+গ>ড+গ, চ+ভ>জ+ভ>জ+ব হয়েছে।
কারণ ছাড়া (বিষমিভবনে) ঃ কাক>কাগ, শাক>শাগ, ফুপু>ফুবু ইত্যাদি।
উল্লেখ্য যে, দেবহাটার উপভাষায় এই ঘোষধ্বনির অঘোষ উচ্চারণ একটা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট। মূলত গ্রাম উচ্চারণে এই বৈশিষ্ট ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। যেমন : খবর>খপোর, গরিব>গোরিপ, আসবে>আশপে, বাবা>বাপা, শাবা>শাপা, বাবু>বাপু, শাবল>শাপোল ইত্যাদি।
১০. রাঢ়ী উপভাষায় অ পরবর্তী ই বা উ ধ্বনি থাকলে আদ্য অ ধ্বনি এর উচ্চারণ ও হয়ে যায়, কিন' উপসর্গ অ এর উচ্চারণ অবিকৃত থাকে। যেমন ঃ অতি>ওতি (অ পরবর্তী ই থাকায় ও তে রূপানি-রিত)। অবিচার>অবিচার (রাঢ়ীতে আদ্য অ উপসর্গ হওয়ায় অ ধ্বনি অবিকৃত)।
কিন্তুবঙ্গালীতে ওবিছার, ওশুখ, ওনীল হয়ে যায়। অর্থাৎআদ্য অ উপসর্গের ক্ষেত্রে অ ধ্বনি অবিকৃত থাকে না। দেবহাটার উপভাষায় এক্ষেত্রে রাঢ়ী রীতিটাই ব্যবহৃত হ’য়ে অবিচার, অশুক, অনিল হয়।
১১. বঙ্গালী উপভাষায় পদমধ্যসি'ত শ, স প্রবৃতি উষ্ম শিষ্ দ্বনি হ তে রূপান্তরিত হয়। কখনো কখনো ছ অর্থাৎঅঘোষ মহাপ্রাণ তালব্য ধ্বনিতে পরিণত হয়। যথা-বস>বহো. সে>হে. আসে>আহে, সকল>হগোল ইত্যাদি (ইম্ম শিস ধ্বনি)।
সময়>ছোমায়, বিশাল>বিছাল, বাস>বাছ, শ্বাসাঘাত>ছাছাগাত ইত্যাদি (অঘোষ মহাপ্রাণ তালব্য ধ্বনি)।
১২. শব্দমধ্যসি'ত ক ধ্বনি বঙ্গালী উপভাষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। যথা- সকল>শোআল, টাকা>টাআ/টেকা ইত্যাদি।
১৩. দেবহাটার উপজেলায় সর্বত্রই অসংখ্য শব্দে রাঢ়ী বৈশিষ্টের প্রভাবে স্বতোনাসিক্যভবন ঘটে। যেমন- কাচ>কাঁচ, হাটু>হেঁইটো, ঝাটা>ঝ্যাঁটা, শাকো>শাঁকো, শোডা>শোঁটা ইত্যাদি।
১৪. রাঢ়ীতে উত্তর পুরুষের অতীতকালের ক্রিয়াপদে লুম, লেম, নু ইত্যাদিব্যবহৃত হয়্। সাউভাতে সেক্ষেত্রে শুধু লাম এবং দক্ষিণ চব্বিশপরগণার কিছু অভিবাসীদের উচ্চারণে নু ব্যবহুত হয়্ যেমন- জাবানু, হবানু, খাবানু ইত্যাদি। সাউভাতে ভবিষ্যৎকালে অবশ্য এ্যনে/আ্যান্ ব্যবহৃত হয়। যেমন- হব্যানে/ন্, দ্যাকপানে ইত্যাদি।
১৫. রাঢ়ীতে প্রথম পুরুষের অকর্মক ও সকর্মক উভয় ক্রিয়ার অনে- ল, লে যুক্ত হয়। সাউভাতে অভিজাতদের মধ্যে লে এবং অনভিজাত শ্রেণীর মধ্যে এ্যালে ও ল্যা ব্যবহৃত হয়। যেমন- লেবো, লেইশো, লেচো (অভি) ইত্যাদি।
১৬. কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঙ্গালী উপভাষায় কিছু কিছু শব্দে অস্থানে স্বতোনাসিক্যভবন ঘটে। যথা- টাকা>টেআঁ, আমি>আঁই (এখানে ম এর বিকল্পে চন্দ্রবিন্দু (আনুনাসিক) ব্যবহৃত হয়েছে), বই>বোঁই ইত্যাদি।
দেবহাটার কোন অঞ্চলে এ জাতীয় উচ্চারণ লক্ষ করা যায়না।
১৭. দেবহাটা উপভাষার শব্দের আদিতে বা মধ্যে হ শিস ধ্বনির যথাযথ প্রয়োগ একটা স্বাভাবিক বৈশিষ্টের অন্তর্ভুক্ত, যা বঙ্গালী উপভাষার রীতি বিরুদ্ধ। কলারোয়ার এই বৈশিষ্ট রাঢ়ী প্রভাবের সংঘটিত।
১৮. স্বতোনাসিক্যভবন রাঢ়ীর একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। এর বৈশিষ্ট সাউভার দক্ষিণ পশ্চিম এলাকাকে প্রভাবিত করছে। উত্তর ও উত্তর পূর্বএলাকায় এই বৈশিষ্ট কোনো প্রভাবিত করতে পারেনি।
১. বঙ্গালী উপভাষায় কর্তৃকারকে (নির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট কর্তায়) এ/য় বিভক্তি যুক্ত হয়;যথা-রামে কয়, বাবায় বারি নাই ইত্যাদি। কিন্তু দেবহাটা উপভাষায় রাঢ়ী রীতি অনুযায়ী কর্তৃকারকে শূণ্য বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যথা- রাম বলে, বাব বাড়িনি / বাইড়ুনি>বাইন্নি (সমিভবন) ইত্যাদি।
২. বঙ্গালীতে মুখ্য ও গৌণ কর্মে কে স্থলে রে বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। কলারোয়ার উপভাষায় এই রে বিভক্তি শব্দান্তে আঞ্চলিক প্রয়োগে অনেক ক্ষেত্রে রি ঘটে থাকে। যেমন- করিম্রি দ্যাও, হরিরি দ্যায় (<দিয়ে আয়) ইত্যাদি। তবে তারে, ওরে, আমারে, হেরে ব্যবহৃত হ’য়ে থাকে। দ্রুত উচ্চারণে রে > র হ’য়ে যায়। এমনকী সমীভবনের ক্ষেত্রে পুরো বিভক্তিটাই লুপ্ত হয়ে যায়। করিমকে বলো > কোরিমির / কোরিমরি বলো। জ্যোতিকে ডাক্্ > জ্যোতিইড্ডাক। হরিকে দিয়ে আয়>হোরিরি দে আয়> হোরিদ্ধ্যায়/ হো / হুইরেদ্দ্যায় ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে দ্রুত উচ্চারণে জ্যোতিরি > জ্যোতির > জ্যোতিড্ (জ্যোতির)ডাক = অর্থাৎর+ড = সমীভবনে ডড’) হয়ে যায়। অর্থাৎদ্বিতীয় বিভক্তির আর অস্তিত্ব থাকে না।
৩. বঙ্গালীতে অধিকরণে ত বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন- বারিত্ যামু, ঘোরিত্ কডা বাইজ্ছে/জে ইত্যাদি। দেবহাটা উপভাষায় ত বিভক্তি তি হ’য়ে যায়। আবার গ্রাম্য উচ্চারণে বিপর্যাস ঘটে। যথা- নোদিতি গাধুতি গেলাম। তোগা বাড়িতি কেডা এইয়েচ্রে? ইত্যাদি।
দ্রুত উচ্চারণে এই তি (ত+ই) এর বিপর্যাস ঘটে ইত্ (ই+ত্) হয়। অর্থাৎনোদিত্ গাধুইত্ জাবো/নোদিত্ গা ধুইজ্জাবো (ত+জ=জজ সমীভবন) বাড়িতে> বাড়িইত্ । এখানে ই বিপর্যাসটা শ্রতিধ্বনির মতো উচ্চারিত হয়।
৪. বহুবচনের ক্ষেত্রে বঙ্গালীতে গো এবং রাঢ়ীতে দের ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দেবহাটা উপভাষায় রাঢ়ী’র দের বিভক্তির পরিবর্তিত প্রয়োগ ঘটে। যেমন-
ক. মধ্য, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব এলাকায় = ইগের (<দের>গের> ইগের) হয়। যথা- আমাইগের, উইগের, আম্নাইগের ইত্যাদি।
খ. দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায়- দের>গের>রগে(বিপর্যাস)>রগা (এ>আ)>গা (দ্রুত উচ্চারণে র’ লোপে ব্যবহৃত হয়)। যথা- আমরগা, তোরগা, আপ/মোনারগা, তাগা, তোগা, আমাগা ইত্যাদি। তবে সাতক্ষীরার সর্বত্র অশিক্ষিত বা অনভিজাত গ্রাম্য উচ্চারণে উত্তম ও মধ্যম পুরুষে সঙকুচিত হ’য়ে আঙ্গা, তোঙ্গা ব্যবহৃত হয়।
৫. রাঢ়ীতে সাধারণ বর্তমানের রূপ বঙ্গালীতে ঘটমান বর্তমানের রূপে ব্যবহৃত হয়। যথা- মা ডাকে (রাঢ়ী রীতি= সাধারণ বর্তমান)।
মায়ে ডাকে (বঙ্গালী রীতি ঘটমান বর্তমান)। কিন্তুসাউভাতে ঘটমান বর্তমানে মা ডেইক্তেচে/চ্ ব্যবহৃত হয়। ঘটমান বর্তমানের ক্ষেত্রে এখানে ভগ্ন অপিনিহিত ব্যবহৃত হ’য়ে থাকে। অর্থাৎরাঢ়ী বঙ্গালীর মিশ্রণ রীতির মতো ব্যবহৃত হয়।
৬. রাঢ়ীতে ঘটমান বর্তমানের বিভক্তি বঙ্গালীতে পুরাঘটিত বর্তমানের রূপে ব্যবহৃত হয়। যথা-বঙ্গালী- আমি/আঁই করশি/কশ্শি (পরাঘাটিত বর্তমান = করছি)। রাঢ়ী- আমি করছি (ঘটমান বর্তমান)।
৭. বঙ্গালীতে সাধারণ ভবিষ্যৎকালের মধ্যম পুরুষে বা এবং রাঢ়ীতে বে ব্যবহৃত হয়। যথা-বঙ্গালী- তুমি যাইবা, দেইখ্বা, বোইল্বা ইত্যাদি। রাঢ়ী- হুমি যাবে, দেখবে, ব’লবে ইত্যাদি।
কিন্তু দেবহাটার উপভাষায় বঙ্গালী রীতি অনুযায়ী অনে- বা ব্যবহৃত হ’লেও রাঢ়ী প্রভাবে মধ্যবর্তী ই ধ্বনির লোপ ঘটে। যথা- তুমি জাবা, দ্যাকপা (<দেখবা), বলবা ইত্যাদি।
৮. উত্তম পুরুষের সাধারণ ভবিষ্যৎকালে বঙ্গালীতে কোথাও মু তাম কোথাও আম বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন :
ক. আঁই/আমি যামু না।খ. আমি/আঁই যাইতাম না।গ. আমি/আঁই যাইয়াম না। কিন্তু রাঢ়ীতে ব বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। এবং ব>বো হয়। যথা- আমি যা না/যাবোনা। সাতক্ষীরার উপভাষাতেও আমি জাবোনা ব্যবহৃত হয়।
৯. রাঢ়ীতে অতীত কালের ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নঞ্র্থক অব্যয়ের ক্ষেত্রে নেই, নি এবং বঙ্গালীতে নাই ব্যবহৃত হয়।
দেবহাটার উপভাষাতেও নি ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া রাঢ়ীতে যে সব জায়গায় নেই এবং বঙ্গালীতে নাই ব্যবহৃত হয়- দেবহাটাতে সেখানে নি ব্যবহৃত হয়। যথা- ক. লতা বাড়ি নেই = রাঢ়ীখ. লতা বারি নাই = চঙ্গালী
গ. লোতা/নোতা/নতা/লতা বাড়ি নি/বাইড়্নি (বিপর্যাস অর্ধ’ই)/বাইন্নি (ড়+ন=ন্ন=সমিভবন) হয়।
১০. অসমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে। ক. রাঢ়ী- দিয়ে = আমি দিয়ে দিয়েছি।খ. বঙ্গালী- দিয়্যা = আমি / আঁই দিইয়্যা দিছি।
গ. দেবহাটা উপভাষায় দে = আমি দে দিচি/চ্। এখানে দে <দিয়ে (রাঢ়ী’ প্রভাব), দিচি< দিছি (বঙ্গালী প্রভাব এবং অনে- চ’ অল্পপ্রাণিভবন রাঢ়ী বৈশিষ্ট। দিচ্ < দিচি (দ্রুত উচ্চারণে অন- ই লোপ)। এরূপ ধ্বনি সংকোচন প্রায়শ ঘটে থাকে।
১১. তুম’ র্থক অসমাপিকা ক্রিয়াপদে-
ক. বঙ্গালী- তা’ / তে বিভক্তি = যাইতে/যাইতা, কোইর্তা/কইর্তে ইত্যাদি।
খ. রাঢ়ী- তে = স্বরসঙ্গতি রূপে = যেতে, খেতে, বলতে।
গ. দেবহাটা উপ ভাষায়- জাতি, খাতি, বোল্তি ইত্যাদি।
এই বৈশিষ্ট বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও চব্বিশ পরগণার দক্ষিণাঞ্চলের বহু জায়গায় ব্যবহৃত হয়।
১২. শুধু অসমাপিকা ক্রিয়া নয় শব্দানে- ই’র প্রয়োগ দেবহাটার উপভাষায় নানাভাবে ঘ’টে থাকে। যেমন-
ক. সপ্তমী বিভক্তিতে - নাতি, জাতি, বোল্তি ইত্যাদি ।
খ. ষষ্ঠী বিভক্তিতে - মান্শির (মানুষের), পুতির (পুতের), শালিকির(শালিকের), বিলির(বেড়ালের) ইত্যাদি ।
গ. অতীত কালের ‘ল’ প্রত্যয়ে - দিলি, গে/গিলি, চোল্লি, কো’লি(কইলে) ইত্যাদি ।
ঘ. পুরাঘটিত অতীতে - পোড়িচি(পেড়েছি), বোলিচি(বলেছি), হাঁশিচি(হেসেছি), দেকিচি(দেখেছি) ।
ঙ. ক্ষুদ্রাকৃতি ও গুটি অর্থে - লেদি/নেদি, খেঁদি, কোচি (ছোট মেয়েকে সম্বোধন), আবড়ি/ আউড়ি (গোলার মতো বৃহৎধান রাখার পাত্র) ইত্যাদি ।
চ. ঝোঁক ও গুরুত্ব প্রদানে - গেলি,আলি (এলি),বোল্লি, শুন্লি, দেক্লি ইত্যাদি ।
ছ. নিম্নধ্বনি উচ্চারণে - বোল্তি (বলতে), খাতি (খেতে), কোতি (কইতে) ইত্যাদি ।
জ. স্বরসাম্যে - দি (<দিই), নি(<নেই) ইত্যাদি ।
সবশেষে বলা যায়, দেবহাটা উপজেলা মূলত বৃহত্তর বঙ্গালী উপভাষা অঞ্চল ও রীতির আওতাভুক্ত । কিন্তু প্রান্তরাঢীয় এলাকায় অবস্থানের কারণে ‘রাঢ়ী’ প্রভাবে স্থানীয় বঙ্গালী রীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে । ফলে, বঙ্গালী ও রাঢ়ী রীতির মিশ্রণে দেবহাটার উপভাষায় মিশ্রবৈশিষ্ট গ’ড়ে উঠেছে । দেবহাটার উপভাষার আঞ্চলিক পরিধি
সাহিত্য:
দক্ষিণ বাংলার প্রাচীন জনপদ দেবহাটা । পলি সঞ্চিত বিস্তৃর্ণ সমতল উর্বর ভূমি,বন-বনানী শোভিত -লিলায়িত ভঙ্গির অনবদ্য ছবির মতো ইতিহাস ভূগোলের নৃতত্বের ত্রিবেনী সঙ্গমে গড়া গাঙ্গেয় বদ্বীপের বাঘ্রতটটি সাহিত্য ও সাহিত্য প্রেমিকদের স্বর্ণভূমি । এ অঞ্চলের সাহিত্য চর্চার ইতিহাসটি অনেক পুরাতন ফরাসি গবেষক সিলভী লেডির মতে মাননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথ এই অঞ্চলের অধিবাসি । চর্চাপদের এই পদক্তাতে এই অঞ্চলের সাহিত্যের আদিম দেবতা মনে করা যায় । ১২শ শতকের দিকে বিশাল আর্থতার সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে বিচিত্র ধর্মবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মোর্গী সম্প্রদায়ের মধ্যে শিব গাজনের পালকারবৃন্দের আর্বিভাব এই অঞ্চলের প্রাচীনত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে ।
শ্রীচৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্ম আশ্রিত কবি যবন হরিদাস ১৩ শতকে কবিতা চর্চায় বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন । ১৫ শ শতকে বসন্তরায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষ্ণব পদকর্তা কবি গোবিন্দদাসের কবিতা চর্চা করার নিদর্শন পাওয়া যায় । প্রতাপাতিদ্যের রাজসভায় আবলম্ব সরস্বতী ও তার ভাই ডিম ডিম সরস্বতির সাহিত্য চর্চা করার কথা সতীশ মিত্র তার যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থ উল্লেখ করেছেন । কিন্তু সাহিত্য চর্চার এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার চিহ্ন খুজে পাওয়া যায় না । বরং দীর্ঘ বিরতিতে দেখা যায় বাংলা গদ্য চর্চার দ্বিতীয়ধাপে অর্থাৎ ১৮ শতকের মধ্যভাগে সাতক্ষীরার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক নিষ্ঠার সাথে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন ।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS